'রঘুরাজপুর', গ্রামটার সাথে আমার প্রথম আলাপ ২০১৬ সালে। একটা বাংলা পত্রিকায় গ্রামটার ব্যাপারে পড়ে সেখানে একবারটি যাওয়ার ইচ্ছে হয়। তাই সেই বছরেই আমাদের পুরীর ট্রিপের একটা বেলা রঘুরাজপুরের জন্য বরাদ্দ করে সকাল সকাল আমি আর গিন্নী বেরিয়ে পড়লাম গ্রামটার উদ্দেশে।
পুরী থেকে গ্রামটার দূরত্ব মাত্র ১২ কিমি হলেও ট্যুরিস্ট দের কাছে জায়গাটা অতটা জনপ্রিয় নয়। তাই পাবলিক ট্রান্সপোর্ট এর ওপর ভরসা না করে, যাওয়া-আসার চুক্তিতে একটা অটো ভাড়া করে যাত্রা শুরু করলাম। পুরী শহর থেকে বেরোতেই ওড়িশার গ্রামীণ দৃশ্য আমাদের উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালো। বেশ কয়েকটা শতাব্দী প্রাচীন মন্দির, গ্রামের কাঁচা পাকা বাড়ি, এবং সারি দিয়ে নারকেল আর তাল বাগান পেরিয়ে আধঘন্টার মধ্যে রঘুরাজপুরে পৌঁছে গেলাম।
কী এই গ্রামের বিশেষত্ব?
রঘুরাজপুরের প্রত্যেকজন গ্রামবাসী জগন্নাথ দেবের আশীর্বাদে এক বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী। আর এই বিশেষ ক্ষমতা হলো তাদের শিল্পশৈলী যা সারা ভারতে কেন সমগ্র বিশ্বে অদ্বিতীয়। এই গ্রামের প্রতিটা লোকই শিল্পী, বংশ পরম্পরায় প্রতিটা পরিবারই হস্তশিল্পের কাজে নিযুক্ত। এখানে যেকোনো বাড়িতে ঢুকলে দেখতে পাবেন বাড়ির সবাই এমনকি মহিলারাও তুচ্ছ থেকে অতি তুচ্ছ জিনিস দিয়ে আপন দক্ষতায় বানিয়ে ফেলছেন একের পর এক সুন্দর হ্যান্ডিক্রাফট। তবে এই গ্রামটা 'পটচিত্রের' জন্য সবথেকে বিখ্যাত। 'পট' হলো কাপড়ের একটা টুকরো যার ওপর এই গ্রামের শিল্পীরা ফুটিয়ে তোলেন বিভিন্ন ছবি, যেগুলোর বেশিরভাগই কোনো পৌরাণিক গাঁথার গল্পকে কেন্দ্র করে আঁকা হয়। প্রতিটা ছবিতেই উজ্জ্বল রং ব্যাবহারের করা হয়। রং হিসেবে বিভিন্ন ফুলের নির্যাস, খনিজ এবং রঙিন পাথর ব্যবহারের রীতি থাকলেও বর্তমানে শিল্পীরা এতে সিন্থেটিক রং প্রয়োগ করে থাকেন। আগেকার দিনে যখন টেলিভিশন , মোবাইল ছিলোনা, তখন কীর্তনিয়ারা এই পটচিত্র নিয়েই গ্রামে গ্রামে ঘুরতেন আর ওগুলোকে দর্শকের সামনে তুলে ধরে, কীর্তনের মাধ্যমে চিত্রের ঘটনা গুলি ব্যাখ্যা করতেন।"
পটচিত্র এবং হ্যান্ডিক্রাফট ছাড়াও এই গ্রামটা বিখ্যাত এক প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী নৃত্যকলার জন্য, যেটার নাম 'গতিপুয়া'। এটা একটা বিশেষ প্রকার আক্রব্যাটিক নৃত্যশৈলী, যেখানে যুবকেরা মেয়েদের বস্ত্র ও সাজে সজ্জিত হয়ে ভগবান কৃষ্ণ বা জগন্নাথ দেবের উদ্দেশ্যে নৃত্য পরিবেশন করেন। এই অনন্য বিশেষত্বের জন্য এই গ্রামকে ২০০০ সালে 'heritage crafts village' এর মর্যাদা দেওয়া হয়।
![]() |
পটচিত্র |
![]() |
রং - বেরংয়ের পটচিত্র |
পটচিত্র এবং হ্যান্ডিক্রাফট ছাড়াও এই গ্রামটা বিখ্যাত এক প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী নৃত্যকলার জন্য, যেটার নাম 'গতিপুয়া'। এটা একটা বিশেষ প্রকার আক্রব্যাটিক নৃত্যশৈলী, যেখানে যুবকেরা মেয়েদের বস্ত্র ও সাজে সজ্জিত হয়ে ভগবান কৃষ্ণ বা জগন্নাথ দেবের উদ্দেশ্যে নৃত্য পরিবেশন করেন। এই অনন্য বিশেষত্বের জন্য এই গ্রামকে ২০০০ সালে 'heritage crafts village' এর মর্যাদা দেওয়া হয়।
অটো থেকে নামতেই দেখতে পেলাম গ্রামে প্রবেশের মূল রাস্তার দুপাশে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কাঁচা পাকা বেশ কিছু বাড়ি। এই বাড়ি গুলোই হলো গ্রামবাসীদের একাধারে বাসস্থান, স্টুডিও আর বিপণী। কাঁচা -পাকা নির্বিশেষে প্রতিটা বাড়ির দেওয়ালেই আঁকা রয়েছে অসংখ্য চিত্র। আর সেই ছবি গুলিতে ধরা পড়েছে রামায়ণ, মহাভারত, জাতক কথা এবং বিভিন্ন প্রাচীন উপকথনের কত কি গল্প। উপযুক্ত রঙের সমাহারে ছবিগুলি যেন কথা বলছে। ঠিক এইরকমই একটা বাড়ির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আমাদের ভেতরে আসার আমন্ত্রণ জানাল বিজয় সাহু, এই গ্রামেরই যুবক ও শিল্পী। তার অকৃত্রিম হাসি মাখানো আমন্ত্রণ উপেক্ষা করতে পারলাম না এবং গিন্নী কে নিয়ে তার স্টুডিওতে ঢুকলাম। বিজয়ের স্টুডিও একটা বেশ বড় সাইজের ঘর, যেটার চারটে দেওয়াল জুড়ে শোভা পাচ্ছিলো বিভিন্ন সাইজের ফ্রেমবন্দি রং-বেরংয়ের পটচিত্র। তিন চার জন শিল্পী ঘরটার এককোনে বসে শুধু পটের ওপরেই নয় তালপাতার ওপরেও ফুটিয়ে তুলছেন একের পর এক দৃষ্টিনন্দন চিত্র। ছবিগুলো শিল্প নিপুনতায় এতটাই নিখুঁত যে নিজের চোখে না দেখলে হয়তো কোনোদিনো বিশ্বাসই করতাম না যে ওগুলো কোনো মেশিনে নয় বরং কোনো শিল্পীর কেবলমাত্র হাতের ছোঁয়ায় তৈরি হয়েছে। পটচিত্র ছাড়াও সেখানে দেখলাম রঙিন সুতোয় ঝোলানো কচি ডাব আর সুপুরি, যেগুলোর ওপর রং করে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে জগন্নাথ দেবের মুখাবয়ব, ফেলে দেওয়া কাঁচের বোতল রং করে, তাতে বিভিন্ন নক্সা এঁকে বানানো হয়েছে চমৎকার ফুলদানি। আরো আছে কাগজের মন্ড থেকে তৈরি বিভিন্ন রকমের মুখোশ, কাঠের তৈরি পাখির মালা, দরজায় বা ব্যালকনিতে ঝোলানোর জন্য, নারকেলের ফুলের তৈরী হরিণ, তালপাতার বুকমার্ক যেটার ওপর জগন্নাথ বা রাধাকৃষ্ণের রঙিন চিত্র খোদিত, ৫০০ মিলির ডেটলের বোতলের সাইজের পাথর কেটে বানানো মন্দির, দেবতার অবয়ব , রথের চাকা ইত্যাদি।
![]() |
স্টুডিওতে ফ্রেমবন্দি বিভিন্ন মাপের পটচিত্র |
![]() |
পাথর কেটে বানানো রথের চাকা , নক্সা কাটা কাঁচের বোতলের ফুলদানি |
![]() |
ছোটদের খেলনা- গাছপালা , পশু-পাখি ইত্যাদি |
![]() |
মুখোশ |
কেন আসতেই হবে এই heritage crafts village এ?
আমরা অনেকেই কোথাও ঘুরতে গেলে সাধ্যমত সেই জায়গার কিছু স্মারক প্রিয়জনদের জন্য নিয়ে আসি। রঘুরাজপুরের হান্ডিক্র্যাফটগুলি প্রিয়জনদের উপহার দেওয়ার জন্য আদর্শ। শুধু উপহার হিসেবেই নয় ঘরসাজবার উপকরণ হিসেবেও ওইগুলো চমৎকার। আধুনিক শপিংমল বা ইকমার্স সাইটের থেকেও অনেক কম দামেই ওই হান্ডিক্রাফটসগুলো এখান থেকে আপনি সংগ্রহ করতে পারবেন। উপযুক্ত সংখ্যক ক্রেতার অভাবে এই শতাব্দী প্রাচীন ঐতিহ্য শিল্প আজ বিপন্ন, বিরল প্রতিভার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও এখানকার শিল্পীদের অর্থনৈতিক অবস্থাও বেশ খারাপ। অনেকেই পূর্বপুরুষের চিরাচরিত এই পেশা ছেড়ে শহরে গিয়ে অন্য কাজ করছেন। এই ভাবে চলতে থাকলে হয়তো কালের গ্রাসে এই অনন্য শিল্পশৈলীটি হারিয়ে যাবে। তাই আমি মনে করি, এই প্রাচীন ভারতীয় ঐতিহ্য রক্ষাহেতু আমাদের উচিত এই গ্রামে যাওয়া এবং সাধ্যমতো এখানকার পণ্যগুলো কিনে শিল্পীদের উৎসাহ দেওয়া। তাই আমার একান্ত অনুরোধ, পরের বার পুরী গেলে অবশ্যই একবার Raghurajpur- The heritage craft village of Odisha য় আসবেন।
কিভাবে যাবেন?
পুরী থেকে, পুরী-ভুবনেশ্বর রোডে বাসে করে চন্দনপুর বাজার এসে সেখান থেকে রিক্সায় রঘুরাজপুর পৌঁছনো যায়। তবে যেহেতু এটা অতটা জিনপ্রিয় ট্যুরিস্ট ডেস্টিনাশন নয় তাই স্থানীয় পরিবহনের ওপর ভরসা না করে যাওয়া আসার চুক্তিতে অটো বা গাড়ি ভাড়া করে নেওয়া ভালো। ২০১৬ সালে এইরকম চুক্তিতে আমাদের অটোভাড়া পড়েছিল ৪০০ টাকা। এখন অবশ্য অনেক হোটেলই তাদের প্যাকেজে একটা দিন রঘুরাজপুর ট্রিপের ব্যবস্থা করছে তাই বুকিং এর আগে একবার হোটেলের সাথে কথা বলে নিতে পারেন।
কিছু প্রয়োজনীয় তথ্য::
- রঘুরাজপুরের গ্রামবাসীরা অত্যন্ত অতিথিবৎসল তবে এমন কোনো আচরণ করবেননা যাতে তাদের ধর্মীয় বা সামাজিক ঐতিহ্যে আঘাত লাগে। কোনোকিছুর ফটো তোলার আগে অনুমতি অবশ্যই নেবেন।
- জিনিস কেনার সময় খুব একটা দরদাম করবেন না।
Raghurajpur- the heritage crafts village of Odisha
Reviewed by AMIT KUMAR DEBNATH
on
October 25, 2019
Rating:

Very good website, thank you.
ReplyDeleteOdia Quotes
Odia Wishes
Odia Quotes Online